নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, নিজেকে বড় আর বিশেষ মনে করার এক উদ্ভট সমস্যা!
শুধু নিজেকে বড় বা খুব জ্ঞানী মনে করা না, এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে খুব বিশেষ কিছু মনে করে আত্মপ্রেমে এত বেশি বিভোর থাকে যা বাস্তব অবস্থা থেকে একেবারে ভিন্ন!
কথায় আছে, “আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।”
Narcissistic Personality Disorder (NPD) হচ্ছে সেইরকম নিজেকে বড় মনে করার এক উদ্ভট অসুস্থ চিন্তা! শুধু নিজেকে বড় বা খুব জ্ঞানী মনে করা না, এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে খুব বিশেষ কিছু মনে করে আত্মপ্রেমে এত বেশি বিভোর থাকে যা বাস্তব অবস্থা থেকে একেবারে ভিন্ন! অর্থাৎ এই ব্যাধি একধরণের ডিল্যুশন বা ভ্রান্ত বিশ্বাস আর মোহের সমন্বয় যা আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে কোনো এক বা একাধিক বিষয় সাপেক্ষে জেঁকে বসে। এবং বলা বাহুল্য যথোপযুক্ত চিকিৎসা বা কোনো বুঝ তাদের মাঝে কার্যকর না করে দেয়া পর্যন্ত তারা সেই ধারণা নিয়েই চলে।
“আমি অনেক বড়”, “আমি এই/ আমি সেই”, ” আরে সে আমাকে কি জ্ঞান দিবে? আমি কম জানি নাকি?”
এধরণের হাস্যকর-রকমের ভ্রান্ত বিশ্বাস তাদের মাঝে বদ্ধমূল হয়ে ঘুরপাক খায়। যা আদতে সত্যি হয় না।
আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এরা অবস্থা, পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই নিজেদের অতিমাত্রার গুরুত্ব দিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, একটা মিটিং হচ্ছে, সেখানে এক কর্মী এমন ভাব নিয়ে বসে আছে যে সে ঐ মিটিংয়ের প্রধান বা কর্তাব্যক্তি জাতীয় কেউ। শুধু যে ভাব নিয়ে বসে আছে তা না, সে মনেপ্রাণে ভাবছেও সেরকম। অথচ তার ভাবের বহি:প্রকাশে কিন্তু ব্যক্তিটি অন্যদের হাসির খোঁড়াক হচ্ছে! হ্যাঁ, সেখানে তার গুরুত্ব আছে, নেই যে তা নয়। কিন্তু কেউ তার নিজ স্বাপেক্ষ অবস্থান, অবদান বা কাজের চাইতেও নিজের গুরুত্ব অনেক বেশি মনে করা শুরু করলে এবং সেই অনুযায়ী গদাইলস্করি চালে চললেই সমস্যা। ব্যক্তিটির কথায়, কাজে আর ধারণায় যদি ব্যাপারটা সুদীর্ঘসময় এবং ঘনঘন প্রকাশ পায়, তাহলে তা নার্সিসিস্টিক ডিসঅর্ডার হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সমস্যাটা আসলে অন্যদের যতটা না মুশকিলে ফেলতে পারে, তার চাইতে অনেক বেশি মুশকিলে ফেলতে পারে স্বয়ং আক্রান্ত ব্যক্তিটিকেই। এমন অস্বাভাবিক অবস্থা পরিচিত কারো মাঝে পরিলক্ষিত হলে অবশ্যই চিকিৎসক বা কাউন্সিলরের (পেশাদার পরামর্শদাতা) শরণাপন্ন হওয়া জরুরী।
এরোগের এমন অদ্ভুত নাম শুনে নিশ্চয়ই অনেকের জানতে ইচ্ছে করে হয়তো, যে এমন একটা নামের উৎস কি, বা মানে কি বা কেনো এমন একটা নাম দেয়া হল এই ব্যাধি । এর উত্তর জানতে হলে আমাদের আগে হাল্কাপাতলা জানা লাগবে নার্সিসাস (Narcissus) এর ব্যাপারে। যারা গ্রীক পুরাণ (Mythology) পড়েছেন তাদের অনেকেই জানেন কে এই নার্সিসাস। হয়তোবা এও বুঝতে পারছেন কেন তার নামে এই রোগের নাম। এই নার্সিসাস এর কাহিনীও কিন্তু কম অদ্ভুত নয়! পড়লেই বুঝবেন কেন তার নামে এই নাম!
প্রাচীন গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী, নার্সিসাস (Narcissus) ছিল প্রাচীন গ্রীসের বৈওতিয়া (Boeotia) প্রদেশের থেসপাইঈ (Thespiae) শহরের এক শিকারি বাসিন্দা। সে ছিল নদীর দেবতা সেফিসাস (Cephissus) ও জলপরী লিরিওপি/ লিরিওপ (Liriope) এর সন্তান। বলা হয় যে শিকারি তরুণ নার্সিসাস ছিল আত্মগরিমায় ভরপুর এক ব্যক্তি। তার গরিমায় সে এতই নিমজ্জিত থাকতো যে যারা তাকে ভালবাসতো তাদেরকেই সে উলটো অবজ্ঞা করতো! তার এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রায়শ্চিত্ত ও কর্মফল প্রদানের দেবী নেমেসিস (Nemesis) তার আকর্ষণ জলাধারের মাঝে এনে দেয়। ব্যস, যে ই নার্সিসাস সেই জলের ধারে যায়, সে ই তার চোখে পড়ে তার নিজের প্রতিচ্ছবি। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনা সে যে কে এই ব্যক্তি! এবং সে তার নিজের মোহেই এতটাই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে যে সেখান থেকে নড়েও না চড়েও না। একসময় সে বুঝতে পারে যে জলের ব্যক্তিটা সে বৈ আর কেউ নয়। নিজেকেই নিজে ভালবেসে মোহে আটকে পড়ার গ্লানিতে সে সেদিক থেকে সরতে পারেনা। আর এভাবেই সে সেদিকে থেকে থেকেই নিজের প্রাণ ত্যাগ করে!
আর এভাবেই নার্সিসাস হয়ে ওঠে কিংবদন্তীর শিক্ষণীয় এক চরিত্র। যা আমাদের শেখায় যে আত্মগরিমায় বিভোর থাকার ফল নিজেরি ধ্বংস ডেকে আনে…
নার্সিসাস এর কাহিনীর সেই মূলনীতি অনুসরণ করেই সাইকোএ্যানালিস্ট (Psychoanalyst) Otto Friedmann Kernberg ১৯৬৭ সালে Narcissistic Personality Structure প্রবর্তন করেন যার সূত্র ধরে ১৯৬৮ সালে জার্মানি সাইকোএ্যানালিস্ট হাইঞ্জ কোহুৎ (Heinz Kohut) নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের প্রস্তাবনা দেন। পরবর্তীতে এটি মানসিক রোগের বিশ্বকোষস্বরুপ DSM (Diagnostic & Statistics Manual of Mental Disorder) এর তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়। DSV V সংস্করণে এটিকে Cluster B গোত্রের ডিসঅর্ডার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। B গুচ্ছের ডিসঅর্ডার হল সেইসব ডিসঅর্ডার যাতে নাটকীয়তা অনেক বেশি থাকে, আবেগীয় ব্যাপার, আর অনোনুমিত আচরণের মাত্রা বেশি থাকে।
প্রতিটা Disorder একাধিক মৌলিক লক্ষণ (Symptom) নিয়ে গঠিত হয়। সেই আচরণের কতগুলো আবার একাধিক ডিসঅর্ডারে পাওয়া যায়। ব্যাপারটা হল কতগুলো রাশি বা সংখ্যা নিয়ে একাধিক সেট তৈরী করা। যেমন : a,b,c,d,e চারটা রাশি এবং এদের একেকটি রাশির উপস্থিতিতে একাধিক সেট যেমন (a,b), (a,b,c), (a,b,c,d), (a,c), (b,c), (b,c,d), (b,d,e), (a,b,d) ইত্যাদি। ঠিক তেমনি Narcissistic Personality Disorder এ তেও একাধিক মৌলিক লক্ষণ থাকে। যার মধ্যে ভ্রান্ত বিশ্বাস বা ডিল্যুশন (Delusion), ম্যানিয়ার আচরণ (কোনোকিছুর প্রতি অতিমাত্রায় উত্তেজনা বা আগ্রহবোধ করা), অবসেসিভ আচরণ (কোনোকিছুর প্রতি আসক্তি বা আসক্তির মত আচরণ) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাই এক্ষেত্রে চিকিৎসক ও অভিজ্ঞ মনোবিশারদ দ্বারা নিরীক্ষণ এর মাধ্যমে ব্যাপারটা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। উপরন্তু এই ডিসঅর্ডার আলাদা করতে পারার আরেকটা উপায় হচ্ছে সুদীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকা এরূপ আচরণ। সচরাচর এই ডিসঅর্ডার বয়:সন্ধি থেকে নিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক তরুণদের মাঝেই বেশি দেখা যায়। তবে এর ভিন্নতাও অল্পস্বল্প কিছু ক্ষেত্রে ঘটে থাকতে পারে।
NPD তে ভোগা ব্যক্তিদের মধ্যে এরূপ চিন্তা সুদীর্ঘকাল ধরে বাসা বেধে বসার ফলে তার ভিত্তি বেশ শক্তপোক্তই হতে পারে। এরা বিভিন্ন বিষয়ে এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসে ভুগে থাকে। এবং সবচে বাজে ব্যাপার হচ্ছে তাদের অনেকে ঠাহরই করেনা যে তারা আদতে এমন একটা সমস্যায় ভুগছে! ফলে ব্যাপারটায় জটিলতা আরো বাড়তে পারে।
বিভিন্ন ধরণের NPD লক্ষণ দেখা যায় ব্যক্তি-বিশেষে।কারো মাঝে এক বা একাধিক। এ ব্যাপারে চলুন তাহলে একঝলক দেখে নেয়া যাক!
১. নিজেকে “মহান” ভাবার ভ্রান্ত বিশ্বাস
পাড়ার আজমত (কাল্পনিক) সাহেব। মধ্যম আয়ের সরকারী চাকরী করেন। সাথে টুকিটাকি রাজনীতিও করেন। কিন্তু হাটাচলার বেলায় এমন একটা ভাব ধরেন যেন পথ দিয়ে কোনো রাজরাজড়া যাচ্ছে! মাঝেমাঝে ভিক্ষুককে দুচারপয়সা দিয়ে বেজায় ভাব ধরেন। কেউ আলাপে বসলে কথায় কথায় নিজের মাহাত্ম্যতা প্রকাশ করেন এভাবে,
“আরে ওই লোক তো পরে আমাকে ফোন করে অস্থির। আরে ভাই আপনি আমার এতবড় উপকার করলেন, আমার মত গরীবের বাসায় একবেলা দুমুঠো খাবার খেলে আমরা ধন্য হবো।”
আলাপকারী ব্যক্তি কিন্তু মনে মনে উনার এরূপ আচরণে বেশ হাসে। যদিও সামনে বলেনা। বলতে গেলে আজমত সাহেব নিজের “মাহাত্ম্য” ভুলে চিল্লাফাল্লা জুড়ে দিবেন!
২. রূপ, গুণ, ক্ষমতার ডিল্যুশন
আপনার কোনো এক বন্ধু, যাকে দেখা যায় প্রায়সময়েই নিজের প্রশংসাতেই পঞ্চমুখ থাকে। ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করে সে অমুক বা তমুক ব্যাপারে বিশাল জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছে। কিন্তু সেগুলোর বেসিক জিনিষগুলো সম্পর্কেও কিন্তু তার যথেষ্ট ধারণা নেই। অনেকক্ষেত্রে ধারণার “ধ” ও নেই। তবু সে কোনো আবিষ্কার বা বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো আলোচনা করলে বলে, “আরো, এগুলা তো আগে থেকেই জানি”, “অনেক আগেই এগুলা পড়া হল” ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি এমন অনেক বিষয়ে সে মাঝেমাঝে বাম হাত ঢুকাতেও দ্বিধাবোধ করেনা! অথচ আপনারা ভাল করেই জানেন তার দৌড় আদতে সেটার ধারেকাছেও না। শুধু তাই নয়, তারমধ্যে দেখা যায় সবসময়েই সে নিজের রূপের প্রশংসা করে। বলে, পাড়ার ছোটভাই আর বন্ধুবান্ধবরা তাকে নায়ক বলে ডাকে। অথচ সে আসলে ভ্রান্ত বিশ্বাসে বিভোর! সে বুঝে না যে ভাল লাগাটা আসলে আপেক্ষিক। জোর করে নিজেকে এমন রুপান্বীত, মেধাবী প্রমাণ করার কিছু নেই।
৩. নিজেকে ভিন্নরকম মনে করার ডিল্যুশন
আমরা সবাই ই ভিন্ন ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহের সমন্বিত রূপের অধিকারী। তবে সেগুলোর মাঝেও অনেককিছুই মিল থাকে। এইসব মিলের বাইরেও কিন্তু একদম ভিন্নরকম চিন্তার অনেকেই থাকে সমাজে, যারা আসলেই বিশেষ। কিন্তু কারো চিন্তায় তেমন ভিন্নতা বা গতানুগতিক এর বাইরে একদম ভিন্ন কিছু না থাকা সত্বেও যদি সে ব্যক্তি সবসময় এই ধারণা পোষণ করে চলে যে,
“আমি এদের মত না, আমি ওদের মত না, আরে আমিতো আমিই। আমার মত আর দুইটা আছে নাকি?”, “আমি যে ‘স্পেশাল’ একটা ‘পার্সন’ সেটা ওরা যেমন বুঝে, আমিও তেমন জানি”
তাহলে তারমাঝে নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি থাকার ঝোঁক প্রবল! এ বিষয়গুলো তাদেরকে আদতে Unique বানাক বা না বানাক, তাদেরকে অন্যের কাছে নীরব হাসির খোঁড়াক ঠিকই বানায়…
৪. অন্যদের কাছ থেকে সম্মান ও আনুগত্য পাবার ঝোঁক
এলাকায় নতুন আসা স্থানীয় থানার জনৈক সাব ইনস্পেক্টর ব্যক্তিটিকে দেখা যায় প্রায় সময় বেশ ঠাট বজায় রেখে চলে। কথাবার্তায় দাম্ভিকতা। তুই তুকারী করে বলাটা বেশ স্বভাব। লোকটাকে বরাবরই দেখা যায় বেশ ঠাট (attitude) দেখিয়ে চলে। যদিও এলাকাবাসী তাকে তাকে বাড়তি সম্মান বা তোষামোদ করা নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু একদিন দেখা গেল, ওই এইলোক কোনো এক সুযোগে এলাকার কোনো এক ছেলেকে জরিমানা করে বসলো। কথা কাটাকাটিতে একপর্যায়ে এলাকাবাসী বুঝতে পারলো লোকটা তার ক্ষমতার চাইতে অনেক অনেক বেশি দাম্ভিক। সে চায় সবাই তাকে খুব সম্মান করুক, ভালমন্দ নানান আচার অনুষ্ঠানে তাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে রাখুক। কিন্তু সেসব অহেতুক আর হাস্যকর দাবী ধোপে টিকতে না পারার ফলে দেখা গেল শেষমেশ তাকে এলাকাটা ছাড়তে হল।
৫. অন্যের মনোভাব, অনুভূতি, কথা বা সমালোচনার প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা
মাঝে মাঝে বহু NPD আক্রান্ত ব্যক্তিরা অন্যদের আবেগ, অনুভূতি বা মনোভাবের প্রতি চরম অসহিষ্ণু হয়। যা মন চায় করার, যা মন চায় তা সঠিক ভাবার এক স্বার্থপর মনোভাব এদের মাঝে সুদীর্ঘসময় ধরে জেগে রয়। কারো হয়তো আজীবন। এদেরকে ভাল কিছু বুঝাতে গেলে বা তাদের ভুলের সমালোচনা করতে গেলে এরা সবসময় সেই খোড়া নীতি অনুসরণ করে, “আমাকে শুধরোবার আগে নিজের ভুলগুলো দেখো।”, “যে যেমন সে অন্যকেও তেমন ভাবে।”
অথচ তারা এটা বুঝেনা যে তাদের সবার ভুল, সবার দোষ একসমান না।কারো দোষ যখন অন্যের অসুবিধের, সমস্যার বা দুর্ঘটনার কারণ হয়, কারো দোষ যদি অনেককেই খারাপ কাজে ও খারাপ চিন্তায় প্রভাবিত করে তখন অবশ্যই তা সমালোচনাযোগ্য। বিশেষ করে সমাজে বিভিন্ন অঙ্গনে প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যক্তিত্বরা এমন চিন্তা করলে তা একেবারেই খোড়া ও অযৌক্তিক। কারণ তারা ভুল করলে অনেকেই সেগুলোকে সঠিক ধরে তাদেরকে অনুসরণ করে। এধরণের মনোভাব পোষণকারীরা অন্যের সমালোচনা যেমন নিতে পারেনা, তেমনি কোনোবিষয়ে তাদের চিন্তার বাইরে অন্যদের কার কেমন চিন্তা বা অভিমত তাও তারা শুনতে নারাজ থাকে। অথচ এটা জরুরী না যে একটা মানুষ সবসময়ে সবক্ষেত্রে সঠিক থাকবে। এরা কখনো তর্কে হারতে চায়না, শত যুক্তি উপস্থাপন করা সত্বেও আর কখনো নিজের ভুলও স্বীকার করেনা। ফলে এধরণের মনোভাব যেমন এদের নিজের জন্যে ক্ষতিকর হয়, তেমনি তা অন্যদের জন্যেও অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় অনেকসময়।
৬. প্রচন্ডরকম হিংসামূলক মনোভাব
অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় NPD তে ভোগা ব্যক্তিরা সুদীর্ঘসময় অন্যদের যশ, খ্যাতি, বুদ্ধির প্রতি প্রচণ্ড হিংসা পুষে রাখে। শুধু যে পুষে রাখে তা নয়। তারা মনে করে যে অন্যেরাও বুঝি তাদেরকে হিংসে করে। অথচ বাস্তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে তাদের হিংসা করার মত কোনো কারণ বা যুক্তিই থাকেনা। এটা হয় আসলে বিপরীতকৌশলে নিজেকে বিশেষ ভাবার মধ্য দিয়ে। “আমি বিশেষ, তাই সে আমার থেকে হিংসে করে, জ্বলে।” এরূপ মনোভাব এদের মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে প্রায়সময়েই, বলা বাহুল্য যা সচরাচর হাস্যকর-রকমের অযৌক্তিক হয়। এরা সাধারণত তাদেরকে অন্যেরা “হিংসে” করার কারণ ঘেটে দেখতে যায়না। কারণ তারা অনেক যুক্তিই নিতে পারেনা। কিন্তু তবুও বদ্ধমূল ধারণা রেখেই দেয় নিজের মাঝে। হিংসে মানুষকে সবসময়েই চলার পথে পেছনে আঁকড়ে ধরে রেখে দেয়। আর এক্ষেত্রেও তার ব্যক্তিক্রম নয়। ফলস্বরুপ NPD আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের প্রতি অযথাই হিংসাত্মক চিন্তা পুষে রেখে অন্যদের নয়, বরঞ্চ নিজেদেরই ক্ষতিটা করে।
৭. প্রতিক্ষেত্রেই ঠ্যাটামি
Narcissistic Personality Disordered’ দের আরেকটা বিরাট সমস্যা যা দেখা দেয় যে এরা অবাধ্যতা আর ঠ্যাটামি দ্বারা ব্যাধিগ্রস্ত থাকে। তাদের চিন্তা যদি ভুল বা ক্ষতিকর হয় আপনি তাদেরকে তাদের চিন্তার বিপরীতে কোনো কিছু বুঝাতে পারবেন না বললেই চলে। যুক্তিসহকারেই বুঝাতে বুঝাতে আপনার নাভিশ্বাস উঠে আসবে তবু এরা ঠ্যাটামি করে নিজের কথার উপরই অটল থাকবে। আপনি যে বিষয়ে পটু সে বিষয়েও তারা আপনার চাইতে বেশি বিজ্ঞতা দেখাতে চাইবে সম্যক জ্ঞান না থাকা সত্বেও। এমনকি অনেকসময় এরা শিক্ষক, চিকিৎসক, গুণী ব্যক্তি, বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞদের কথাতেও পাত্তা দেয়না। সব বিষয়ে নিজেকে খুব সমঝদার মনে করার একটা ভ্রান্ত ধারণা জেঁকে থাকে এদের মাঝে। ফলে অন্য কেউ ভালর জন্যে কিছু বললে সেটাতে এরা অবজ্ঞা ভরে ঠ্যাটামি দেখায়। আর বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রেও বিষয়টা মূলত তাদের জন্যেই হানিকারক।
NPD এর কারণ
দু:খের বিষয় হল, আপাতদৃষ্টিতে উপেক্ষিত কিন্তু গুরুতর এই সমস্যা পুঙ্খানুপুঙ্খ উৎস বা কারণ এখন অবধি বের করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে অনুমিত কারণগুলোকে দুইভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। তবে এগুলো সুনিশ্চিত কোনো কারণ নয়।
১. সামাজিক ও পারিবারিক : শিশুবয়সে পরিবার থেকে মাত্রাতিরিক্ত আহলাদ পাওয়া এবং বিনা বিচারে ন্যায়, অন্যায়, ভুল ও সঠিক সব কাজেই সায় দিয়ে বড় করা। আবার পক্ষান্তরে সমালোচনার শিকার হওয়া, সমাজে অনেকের কাছে
ব্যাঙ্গর মুখোমুখি হওয়াটাও এটার কারণ হতে পারে।
২. জৈবিক কারণ :
জৈবিক কারণে প্রথমত জীনগত কারণ গর্ভাবস্থায় বিকাশজনিত কোনো কারণে এমন কিছুর প্রভাব পরবর্তী জীবনে ঘটে থাকতে পারে।
অপরদিকে অন্য আরেকটি জৈবিক কারণস্বরূপ কোনধরনের স্নায়বিক সমস্যা, মস্তিষ্কের আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়ায় কোনো সমস্যার দরুণও এমনটা হতে পারে।
NPD’র চিকিৎসা
নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা বিষয়। এর মুল কারণ হচ্ছে স্কিৎষোফ্রেনিয়া (উচ্চারণভেদে ষিজোফ্রেনিয়া) বা ম্যানিয়ার মত সমস্যার মত এক্ষেত্রে ঔষধ প্রয়োগে কাজ চালানো যায়না। কাউন্সেলিং আর থেরাপিই মূলত দরকার পড়ে। আর সমস্যা এখানেই। যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে নিজের বিশ্বাসের প্রতি প্রচন্ডরকমের অহংবোধ কাজ করে এবং যেহেতু তাদের মাঝে ঘুরে ফিরে নিজেদের সঠিক মনে করার প্রবণতাটাই কাজ করে, সেক্ষেত্রে একা কোনো থেরাপিস্ট এর পক্ষে এদেরকে সহজে নিজেদের ধারণার বাইরে কিছু বুঝানো অনেক কষ্টদায়ক, এবং অনেকাংশেই অসম্ভব।তাই এক্ষেত্রে গ্রুপ থেরাপি, মানে অনেকগুলো সাইকিয়াট্রিস্ট/কাউন্সিলর এর সম্মিলিত থেরাপি কার্যকর হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এক্ষেত্রে অনেকেই Mentalization based therapy, transference-focused psychotherapy, ও schema-focused psychotherapy পদ্ধতিগুলোর প্রয়োগ সমর্থন করে থাকেন। তবে থেরাপি যেটাই দেয়া হোক না কেনো। তাদের আচরণ যদি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়, তবে প্রথম কাজ হবে যেভাবেই হোক, ভুলিয়ে ভালিয়ে তাদেরকে আগে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া। শুধু চিকিৎসক না, ভালমানের কোনো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া। তারপর বাকিটা চিকিৎসক নিজেই বুঝে নিবেন রোগীর চিকিৎসা কোনভাবে করলে ভাল হবে।
তবে এছাড়াও ব্যক্তিটির পরিবার, স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও কাছের মানুষদের সম্মিলিত সমর্থন, মানবিক সাহায্য একান্ত প্রয়োজন।
সঠিকভাবে সুদীর্ঘ থেরাপির মাধ্যমে গুরুতরভাবে ভোগা কেউ বেরিয়ে আসতে পারে নিজের বুনা বিষাক্ত এই জাল থেকে।
No comments:
Post a Comment